যশোরে হারিয়ে যাচ্ছে স্টুডিও,প্রযুক্তির দাপুটে থাবায় মলিন অ্যালবামগুলো কেবলই স্মৃতি - Jashore Tribune

Breaking

Home Top Ad

Post Top Ad

a1

Friday, August 28, 2020

যশোরে হারিয়ে যাচ্ছে স্টুডিও,প্রযুক্তির দাপুটে থাবায় মলিন অ্যালবামগুলো কেবলই স্মৃতি

 


যশোরে হারিয়ে যাচ্ছে স্টুডিও। যাচ্ছে বললে ভুল হবে! অনেকগুলো গেছেও। প্রযুক্তির দাপুটে সময়ে এনালগ স্টুডিও টিকতে পারেনি। এ কারণে ছবি তোলার সেই জৌলুস এখন আর নেই। কম্পিউটারে প্রিন্ট করা স্বল্পস্থায়ী ছবিতে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সকলকে।

এক সময় আনন্দ আড্ডা কিংবা স্মৃতি ধরে রাখতে স্টুডিওর জুড়ি ছিল না। উৎসব, উপলক্ষ, পারিবারিক, সামাজিক নানান অনুষ্ঠানের হাসি, কান্নার মুহূর্তগুলো স্মৃতির অ্যালবামে ধরে রাখতে স্টুডিও ছিল ভরসা। আনন্দ, আড্ডা আর হৈ হুল্লোড় করে দলবেধে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা ছিল বিনোদনের অন্যতম একটি অংশ। প্রযুক্তির কল্যাণে স্টুডিওর স্বর্ণালি সেই সময় আজ আর না থাকলেও ধুলোমাখা মলিন অ্যালবাম আজও মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা গৌরবময় সময়ের হাজারো স্মৃতি। ফেসবুক এখন ডিজিটাল অ্যালবামে পরিণত হলেও ঘরের কোণে পড়ে থাকা কাগুজে অ্যালবামটি যেন মাঝে মাঝেই নষ্টালজিক করে তোলে মনকে। আর সেই অ্যালবামের নেপথ্যে থাকা স্টুডিওগুলো নামমাত্র বেঁচে আছে মলিন হওয়া ছবির মধ্যে।
যশোরে স্টুডিওর প্রচলন শুরু হয় ত্রিশের দশকে। ব্রিটিশ শাসনামলে চৌরাস্তায় প্রথম একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। যা আবার পরবর্তীতে বিলুপ্তও হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে আমিরুল হকের তত্ত্বাবধানে ইলা স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত,ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে প্রকৃত অর্থে যশোরে স্টুডিও সংস্কৃতির শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত আলোকচিত্রী এসএম শফির হাত ধরে। তিনি ১৯৫৩ সালে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে পূর্ব প্রান্তে রেটিনা নামে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সেটি বাদ দিয়ে তিনি চৌরাস্তায় ঊষা নামে আরেকটি স্টুডিও পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এর বাইরে রেলরোডে ফটোফোকাস নামে আরও একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন এসএম শফি। পরবর্তীতে তিনি ফটোফ্লাস নামে আরও একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন আরেক ভাই খোকনকে।
ছবি তোলা ও স্টুডিও ব্যবসার প্রসারে ১৯৬৮ সালে যশোর শহরে প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন মুক্তিযোদ্ধা এসএম শফি। সেটিই ছিল যশোরে প্রথম কোনো আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আলোকচিত্রী এসএম শফি পরিবারের সদস্যরা যশোর শহরে ১১টি এবং বেনাপোলে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করে। এগুলোর মধ্যে ছিল মিতালী, মলি, অজন্তা, ইলোরা, ফটোফোকাস-১, ফটোফ্লাস, ফটোজেনিক, ফটোমুভি, সারথী, মুন ও লিডিয়া স্টুডিও। বর্তমানে মোট ২২টি স্টুডিওর কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন যশোর জেলা আলোকচিত্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান।  
পাকিস্তান আমলে দড়াটানায় সিদ্দিক ফটোগ্রাফি, চিত্রার মোড়ে আর্ট গ্যালারি, রেলরোডে সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখার পাশে রিপন স্টুডিও, রেলরোডে ফটোফোকাস, আব্দুর রহিম কালুর তত্ত্বাবধানে ইলোরা, বিরেনের তত্ত্বাবধানে রেমো, জামানের তত্ত্বাবধানে শিমুল ও রিপন স্টুডিও, শাহিনের তত্ত্বাবধানে রূপান্তর, আমিরুল হকের তত্ত্বাবধানে ইলা স্টুডিও, জিতেন্দ্রনাথ হালদারের কণা স্টুডিও, ফজলুর রহমানের মুক্তা স্টুডিও, আবুল হোসেনের তত্ত্বাবধানে স্টুডিও রিপন, আজিজুর রহমান খোকনের ফটোফ্লাস,মসিয়ার রহমানের স্টুডিও জেরিন প্রতিষ্ঠিত হয়। কাছাকাছি সময়ে তৈরি হয় অজয় স্টুডিও। এছাড়া, বকুলতরায় গরিব শাহ মাজারের কাছে আরেকটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির নাম ছিল মিতা স্টুডিও। এসব স্টুডিওর মধ্যে বর্তমানে ফটোফ্লাস ও রোমোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০০০ সালের পরে নিউমার্কেট, ক্যান্টনমেন্ট, মণিহার, পালবাড়ি, চাঁচড়া, আরএন রোড, রেলরোড, চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে নতুন আরও কয়েকটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। মধুমিতা, মিতালী, তাজ, অজন্তা, ফটোফ্লাস, ফুজি, মণিহার ও স্পন্দন কালার ল্যাবসহ বেশ কয়েকটি স্টুডিও এখনো সচল রয়েছে।  
আধুনিক নানান ডিভাইসের সহজলভ্যতার কারণে স্টুডিও ব্যবসা এখন অনেকটাই ম্লান। যাও চলছে তা পূর্ব পুরুষের পেশার প্রতি ভালোবাসা ও মায়ার টানে! কোনোমতে টিকে আছে এগুলো। স্টুডিওগুলোতে বর্তমানে ছবি তোলা ও প্রিন্ট করার কাজ চলে। কিন্তু সেটি একেবারেই হাতেগোনা।
যশোরে  আলোকচিত্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, ফটোগ্রাফার মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠন থাকলেও বর্তমানে তার কার্যক্রম নেই। সেই সময়ের স্টুডিওগুলোর বর্ষিয়ান মালিকপক্ষ, ক্যামেরাম্যান ও কর্মীদের অনেকেই এখন পরলোকগত। কেউবা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। কারো কারো উত্তরসূরীরা স্টুডিও ব্যবসা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন।
অতীতে বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক ছবি তোলার কাজ চলতো। তখন স্টুডিওগুলো এসব কাজের দায়িত্ব পেত। প্রযুক্তি সহজতর হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে স্টুডিওর কার্যক্রম। এছাড়া, ন্যায্য মজুরি না পাওয়ায় বিয়ে, জন্মদিন, আকিকাসহ বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ছবি তোলার কাজে এখন আর স্টুডিওগুলো যেতে সেভাবে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে, দিন দিন কমে চলেছে স্টুডিওর কাজ।
স্টুডিও ফটোফ্লাসের বর্ষিয়ান আলোকচিত্রী জগন্নাথ মোদক বলেন, ‘ছবি তোলাটা একটি শিল্প। আর শিল্প কখনো অদক্ষ হাতে হতে পারে না। এ সময়ে এসে অনেকেই নানান ধরনের ডিভাইসে ছবি তুলছে। নিজেদের তারা আলোকচিত্র শিল্পী বা ফটো সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে থাকে। যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।’   
আলোকচিত্রী সানোয়ার আলম সানু বলেন,‘একটা সময় স্টুডিও ছিল মানুষের খুব প্রিয় একটি জায়গা। ছেলেবেলায় দেখেছি মানুষ তাদের আনন্দ ও সুখের মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে স্টুডিওতে ছুটতো। প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে উঠতে স্টুডিওর বিকল্প ছিল না। কিন্তু এখন তরুণ প্রজন্মের অপেশাদার অনেকেই স্টুডিওকে অনৈতিক কাজের একটি ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।’
যশোর জেলা পর্যায়ে সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কারপ্রাপ্ত আব্দুর রহিম কালু বলেন,‘স্টুডিওর এনালগ সময়ের কাজগুলো ছিল অনেক কঠিন। তখন ফাঁকিবাজির সুযোগ ছিল না। দক্ষতা না থাকলে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না তখন। এখন ডিজিটাল সময়ে এসে কমবেশি সবাই নিজেদের আলোকচিত্রী বা ফটো সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা না বোঝে কাজ, না বোঝে এ পেশার মাহাত্ম। তাই কাজের মানও থাকছে না। স্টুডিওগুলোও প্রায় ধ্বংসের পথে।’   
যশোর জেলা আলোকচিত্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান বলেন,‘সংগঠন থাকলেও সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম এখন আর নেই। বর্তমান কমিটি ১০ বছরের পুরনো। করোনা পার হলে নতুন কমিটি করার বিষয়ে ভাবছি। তখন বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোবো।’    
স্টুডিওর বিষয়ে দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন বলেন,‘একটা সময় ছিল যখন আমরা নিয়ম করে স্টুডিওতে আড্ডা দিয়েছি। সকাল ১০টা, ১১টা কিংবা দুপুর একটায় সেই আড্ডা বসতো। দড়াটানার আলম স্টুডিওতে ওই সময়ের বিশিষ্টজনেরা আসতেন। আমাদের আড্ডার প্রাণ ছিলেন তরিকুল ইসলাম ভাই, মিজানুর রহমান তোতা ভাই, শামসুর রহমান কেবল ভাই, বজলুর রহমান, মজিবুর রহমান, বদরুল আলম ভাইদের মতো বিশিষ্টজনেরা।’
মাওলানা মোহাম্মদ আলী সড়কে ছিল স্টুডিও ‘রূপান্তর’ স্টুডিও। এখানে সকাল বিকেলে জমজমাট আড্ডা চলতো। শহরের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নিতেন্। এ আড্ডায় থাকতেন রুকুনউদ্দৌলাহ, কিরণ সাহা, অশোক সেন, শাহাদত হোসেন কাবিল, হারুন জামিল। প্রবীণ রাজনীতিক কমিউনিস্ট নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম, আব্দুল হাই, অ্যাডভোকেট ফিরোজ, মুক্তিযোদ্ধা খুরশিদ আনোয়ার বাবলু,সমাজকর্মী স ম কাঁচা, একরাম-উদ-দ্দৌলা, সোমেশ মুখার্জীসহ অনেকেই ছিলেন এ আড্ডার নিত্যসঙ্গী।
রূপান্তরের মালিক ছিলেন আব্দুল মান্নান শাহীন। আওয়ামী লীগ অন্তপ্রাণ। তার বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ায়। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি যশোর ছেড়ে ফের কুষ্টিয়া চলে যান।
তিনি যশোরের সাংবাদিকদের বিভিন্ন ছবি দিয়ে সহায়তা করতেন। নিজের কাজ ফেলে চলে যেতেন সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে সহযোগিতার জন।

নিউজঃ গ্রামের কাগজ

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad